ঠিক যেন লাভস্টোরী টু – 6
প্রতিদিনকার নিয়ম মেনে ভোর হয়েছে বস্তিতে। সকাল হবার সাথে সাথে কলরব মুখর হয়ে উঠেছে নিস্তব্ধ বস্তি। সৃষ্টি সেই সকালে উঠে রান্নার কাজ সেরে ভাইকে খায়িয়ে বেরিয়ে গেছে স্কুলে। রোদ্দুর তখনও ঘুমে। ছেলের দিকে তাকিয়ে সৃজন ভাবে ছেলেটা বড্ড ঘুম কাতুরে হয়েছে। হাজার ডাকলেও সকালে উঠতে চায়না কিছুতেই। এদিকে স্কুলের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে তাড়াতাড়ি ডেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরী হতে বলে সৃজন। রোদ্দুর ও রোজকার মতো উঠে তৈরি হয়ে নিয়ে ব্যাগ কাধে বেরিয়ে আসে বাইরে।
কলতলা পার হওয়ার সময়ে দেখে বসে বসে বাসন মাজছে রিতা। রিতার দিকে তাকিয়ে হাসে রোদ্দুর। চোখ নামিয়ে এক মনে বাসন মাজতে থাকে রিতা। একবার এর জন্যেও তাকাচ্ছে না দেখে রাগ চড়ে যায় রোদ্দুর এর মাথায়। মনে মনে বলে ভাব দেহনা ছেমরির, মনে হয় আমারে দেহেই নাই!! এদিকে বাসন মাজতে মাজতে মনে মনে বলতে থাকে ইসসস ভাব দেহাইতেছে যেন বড় ইস্কুলে যাইতাছে! যাইতাছে তো ওই বদ গুলার সাথে বিড়ি টানতে!!
কলতলা পেরিয়ে আস্তে আস্তে রোদ্দুর এগিয়ে যায় ওদের আড্ডার জায়গাটার দিকে। কেমন যেন ফিসফিস করে কথা বলছে আজ নুরা আর শামসু! অকে দেখে প্রতিদিন এর মতো হেসে কিবে ওদ্দুর বলে সম্বোধন করলো না দেখে যেন একটু অবাক ই হলো রোদ্দুর। বরং কেমন যেন একটু চমকেই উঠলো রোদ্দুর কে দেখে!
– কিবে ভুত দেখছস নাকি? অমন কইরা চাইয়া আসোস ক্যা?
– এমনি। বস এইহানে।
রোদ্দুর দেখে নুরা শামসু দুজনেই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ওর দিকে!! কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা ও। হঠাৎ ওর নজর যায় একটা জার এর দিকে। ভেতরে তেল না কি যেন। কিবে তোরা ত্যাল এর ব্যাবসা শুরু করলি নাকি? থতমত খেয়ে যায় ওরা। নুরা তারাতাড়ি করে বলে না না ওই পাশের দোকানের পেট্রোল শ্যাষ হয়া গেছে, তাই আমাগো আনতে দিছিলো। চল শামসু দিয়া আহিগা! শামসু হঠাৎ উঠে দাড়াতেই ওর কেল থেকে একটা ব্যাগ পরে যায়। রোদ্দুর তাকিয়ে দেখে ব্যাগটা ভরা টাকা। দেখেই কেমন আৎকে ওঠে ও।
– কিবে চুরি করছোস তরা!!!!
– নাবে! কইলাম না দোকানের ট্যাকা এগলা। আমাগো কাম আছে, অহন যা ইশকুলে যা তুই।
ওকে রেখেই চলে গেল নুরা আর শামসু। অগত্যা কি আর করা!! মন না চাইলেও স্কুলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ও। আজ অনেকদিন পরে স্কুলে এসেছে ও, কিন্তু মনটা পরে আছে নুরাদের অখানে। ও নিশ্চিত ওর কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে ওরা! কিন্তু কি লুকাচ্ছে? ভেবে পায়না? অতগুলো টাকাই বা ওরা পেলো কোথায়?? এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লাস শেষ হয়ে যায়। বাড়ি ফেরে রোদ্দুর।
মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না! কেমন যেন খচখচ করছে মনের ভেতরে।
সন্ধ্যার পরে রিতার কাছে যাওয়ার কথা ভাবলেও কেন যেন মন টানলো না! মনের ভেতর কেমন খচখচানিটা যাচ্ছে না! কি লুকোচ্ছে ওরা ওর কাছ থেকে!! রাতে অনেকক্ষন ভেবেও কোনো কুল কিনারা না পেয়ে ঘুমাতে যায় রোদ্দুর।
রাত প্রায় তিনটা। একটা পেট্রোল এর জার হাতে নিয়ে সমিতির সেই পরিত্যক্ত বাড়ি টার কাছে এসে দাঁড়ায় দুজন মানুষ। চারপাশ নিরব নিস্তব্দ। দক্ষিন দিক থেকে বাতাস বইছে। অনভ্যস্ত হাতে পেট্রোল জার টা খুলে পেট্রোল ছেটাতে থাকে বাড়িটার গায়ে। ওরা ভেবেছে কেবল এই বাড়িটাই পুড়বে, কিন্তু রাতের বাতাসে পেট্রোল ছড়িয়ে পরার ভয়াবহতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞ্যান নেই এদের। পেট্রোল ছেটানো শেষ হতেই ম্যাচ বক্সটা বের করে আগুন জালিয়ে ছুড়ে মারে দেয়ালের গায়ে।
মূহুর্তেই জলে ওঠে পরিত্যক্ত বাড়িটা সেই সাথে বাতাসে পেট্রোল মিশে দ্রুত ছড়িয়ে পরতে থাকে আগুন! এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা! দূরে কে যেন চেচিয়ে ওঠে আগুন আগুন বলে। লোকজন জেগে গেছে টের পেয়ে যেন সম্বতি ফিরে পায় দুই যুবক। অপেক্ষাকৃত লম্বা যুবকটা চেচিয়ে বলে তাড়াতাড়ি পালা শামসু! দৌড়ে মিশে যায় ওরা রাতের অন্ধকারে। বাতাস পেয়ে লকলকিয়ে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোনো দানব যেন তার বিশাল জিভ টা বের করে ছুটছে সব কিছু গ্রাস করতে।
দ্রুত চারদিকে ছড়াচ্ছে আগুন! আগুনের আঁচ গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙে যায় সৃষ্টির। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই যেন চোখ ঝলসে ওঠে কমলা রঙের আগুনে। ঘর ভরে উঠেছে ধোয়ায়। নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। সৃজন ও জেগে গেছে, কিন্তু কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সৃষ্টিকে একবার রোদ্দুরকে ডাকতে যায় কিন্তু নাক মুখে ধোঁয়া ঢুকে কাশিতে দম বন্ধ হয়ে আসে। আগুন আর ধোয়ায় ভরে উঠেছে ঘর। দরজাটা কোথায় ঠিক আঁচ করতে পারছে না। এদিকে সারা বস্তির লোক জেগে গেছে।
আগুন আগুন করে চিৎকার করে বালতি হাতে ছুটছে সবাই। এখনই আগুন না নেভাতে পারলে একটা ঘর ও বাঁচানো যাবে না আর।
এদিকে ঘুম ভেঙ্গেছে রিতার ও। ওদের ঘরটা বাতাসের উল্টো দিকে থাকায় আগুন এখনো এদিকটায় আসেনি। তারপরও ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাৎ করে ওঠে। দৌড়ে বাইরে এসে দেখে সবাই আগুন নেভাতে ছুটছে। আশেপাশে তাকিয়ে রোদ্দুরদের কাউকে দেখতে না পেয়ে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে ওর বুকটা। তাকিয়ে দেখে উত্তপ্ত তন্দুর হয়ে উঠেছে রোদ্দুর দের ঘরটা। সেদিকে দৌড়ে যায় ও।
সামান্য ধাক্কাতেই খুলে যায় পুরতে থাকা দরজাটা। ঘরে ঢুকে ধোঁয়া তে কিছু চোখে পরেনা ওর। আবছা মতো কানে আসে একটা গোঙানির আওয়াজ। দ্রুত এগিয়ে যায় সেই দিকে। তখনো পুরো সংজ্ঞা হারায়নি সৃষ্টি। কাছে গিয়ে রিতা বলে ভাবি তাড়াতাড়ি ধরেন আমারে। সৃষ্টিকে দাড় করিয়ে দুজন মিলে সৃজনকে দুদিক থেকে ধরে বাইরে বের করে আনে ওরা।
বাইরে আসতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সৃষ্টি। আমার রোদ্দুর!! রোদ্দুর ভেতরে এখনো। ভাবি আপনে থাকেন আমি ওরে আনতাছি।
রিতা আবারও দৌড়ে ঢুকে যায় ঘরের মধ্যে। এদিকে আগুন আরও বেড়ে উঠেছে ধোঁয়ায় দু চোখ জলে যাচ্ছে রিতার। রোদ্দুরকে পেয়ে ওকে দু’হাতে টেনে তোলে রিতা। রোদ্দুর তখন প্রায় অচেতন। রোদ্দুর কে ধরে দরজা পর্যন্ত আনার পরেই দেখে আগুনে পুড়ে খসে পরছে জলন্ত ভারী দরজাটা। রিতা কোনো রকমে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় রোদ্দুরকে জলন্ত দরজার নিচে চাপা পরে ওর শরীরটা। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে সৃষ্টি। মেয়েটা চাপা পরেছে দরজার নীচে। ততক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে রোদ্দুর।
অবিশ্বাস্য চোখে বারবার তাকাতে থাকে আশেপাশে। ঘটনার আকস্মিকতায় কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠছে ওর। ও যেন এখন একটু একটু বুঝতে পারছে সকালে নুরা আর শামসুর অস্বাভাবিক আচরণ এর কারন। হটাৎ কেমন গা গুলিয়ে ওঠে ওর। হরহর করে বমি করতে থাকে বসে। ততক্ষণে লোকজন জলন্ত ভারী দরজাটার নীচ থেকে বের করে এনেছে রিতার শরীরটা। রোদ্দুর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
রিতার শরিরের একপাশটা পুরে কেমন দগদগ করছে, ওর লম্বা চুলগুলো পুড়ে কেমন দলা পাকিয়ে আছে মাথার ওপরে। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে রিতার অজ্ঞান দেহটা নিয়ে যায় হাসপাতালের দিকে। আগুন নিভে এসেছে ততোক্ষণে। ক্ষয়ক্ষতি বলতে সমিতির ঘরটা পুরোটাই পুরে গেছে, রোদ্দুরদের ঘরটা কোনোভাবে দাড়িয়ে আছে কঙ্কাল এর মতো। আশপাশের আরো কিছু ঘরের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। লোকজন তাড়াতাড়ি জেগে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো গিয়েছে অনেকটাই।
সমিতির পোড়া ঘড়টার এক পাশে পরে আছে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা লাশ। বিশুর মা বুড়ি বলে চেনাই যাচ্ছেনা লাশটাকে। বস্তির সব লোক জড় হয়েছে জায়গাটাতে এসে। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। সৃজনকে রেখে সৃষ্টি আর রোদ্দুর গেলো হাসপাতালের দিকে। সৃষ্টি ভাবছে ভয়াল রাতটার কথা! যদি মেয়েটা না থাকতো তাহলে বাঁচতো না ওদের কেউ। ওরা হাসপাতালে গিয়ে শুনলো জ্ঞান ফিরেছে রিতার। তবে ডাক্তাররা এখনো কিছু বলতে পারছে না। নার্স এসে একবার শুধু বলল আপনাদের মাঝে রোদ্দুর কে?
পেশেন্ট তাকে ডাকছে। যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ায় রোদ্দুর। সবটা এখনো কেমন দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে ওর কাছে। নার্স এর পেছনে পেছনে যায় বার্ন ইউনিট এর কাছে। ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় রিতার ব্যান্ডেজ মোড়া শরীরটা। আস্তে আস্তে গিয়ে বসে রিতার পাশে। নার্স বেরিয়ে যায় ওকে রেখে। রোদ্দুরকে দেখে হালকা হাসার চেষ্টা করে ও।
রিতার একটা হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় নেয় রোদ্দুর। অনেক চেষ্টা করেও ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নাটাকে আটকাতে পারে না রোদ্দুর। কাঁদতে কাঁদতে বলে তর কিছু হইবো না রিতা, আমি তর কিছু হইতে দিমুনা।
– ক্যা? আম ক্যাডা তোর? কাইল না কইলি আমি কেউনা!!
– তুই আমার সব। তরে আমি ভালোবাসি রিতা। অনেক ভালোবাসি।
এই কথাটাই তো ও রোদ্দুর এর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলো। আর কোনো দুঃখ নেই ওর। ওর জানা হয়ে গেছে। রোদ্দুর ওকে ভালোবাসে। হ্যা সত্যি ওকে ভালোবাসে রোদ্দুর।
মুখে বলে কি কইলি? আবার ক তো একটু।
– আমি তরে ভালোবাসি রিতা।
– ইসস কথা দেখছনি ছ্যামড়ার!! আমারে নাকি ভালোবাসে আমি কইলাম বয়সে তর থাইকা মেলা বড়।
চোখ মুছতে মুছতে রোদ্দুর বলে উইঠা খাড়া না আগে, মাইপা দেখমুনে ক্যাডা বড়।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় যেন রিতা।
– রোদ্দুর আমার একটা কথা শুনবি তুই???
– তুই ভালো হ আগে, একটা ক্যান হাজারডা শুনমু। তুই যাই কইবি তাই শুনমু আমি।
– আমারে কথা দে ওই নুরা, শামসুগো লগে আর মিশবি না তুই? প্রতিদিন ইশকুলে যাইবি, পড়ালেখা করবি আর বাপ মায়ের কথা শুনবি ক আমারে।
– কথা দিলাম তুই যা যা কইলি সব শুনমু আমি।
– হিঃ হিঃ তুই আসলেই অনেক ভালা রে। দেখমুনে কেমন রাহস আমারে দিয়া কথা!!! আমি কিন্তু কইলাম যদি মইরাও যাই ভুত হয়া নজর রাখমু তর উপরে!!
– না তর কিছু হইবো না কইলাম, কিচ্ছু হইতে দিমু না তর আমি।
– এই ছ্যামড়া একটাবার চুমু খাইবি একটু আমারে?
রোদ্দুর ওর ঠোঁট দুটো নামিয়ে আনে রিতার কপালের ওপরে। হঠাৎ একটা হেচকি তোলে রিতা। তারপরেই ওর মাথাটা কাৎ হয়ে যায় বালিশের এক পাশে। রোদ্দুর এর ধরে থাকা হাতটাও কেন যেন শিথিল হয়স আসে।
প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেনা রোদ্দুর। রিতাকে ডাকতে থাকে সমানে
– রিতা এই রিতা কি হইলো তর? কথা কসনা ক্যা? রিতা এই চোখ খোল দেখ রিতা রিতা এই রিতা হঠাৎ রিতা য়া য়া য়া য়া বলে জোড়ে একটা চিৎকার দেয় রোদ্দুর। ওর চিৎকার শুনে ডাক্তার, নার্স,সৃষ্টি সবাই দৌড়ে আসে। ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে গিয়ে রিতার হাতটা তুলে নেয় হাতে। পালস রেট পরীক্ষা করে বলে স্যরি আমাদের আর কিছুই করার নেই।
ততোক্ষণে সূর্য উঠে গেছে, হাসপাতালের জানালা গলে সকালের সোনালি রোদ্দুর এসে পরেছে রিতার মুখের ওপর। ভোরের সূর্যের সোনালী আলোতে অদ্ভুত মায়াবী লাগছে মুখটা। দেখে মনে হয় যেন অঘোরে ঘুমোচ্ছে রিতা, ঘুমের ঘোরেই যেন এক চিলতে হাসি লেগে আছে ওর দু ঠোঁট এর ফাকে। বোবা দৃষ্টিতে রোদ্দুর চেয়ে আছে মুখটার দিকে।
দুপুর হয়ে গেছে। বস্তির পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। সমিতির পোড়া ঘরটা আর রোদ্দুরদের আধাপোড়া ঘর সাক্ষ্য দিচ্ছে গত রাত্রির ঘটনার। সমিতির ঘরটার সামনের বিশাল আম গাছটার ছায়াতে পাশাপাশি দুটি খাটিয়ার ওপরে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে বুশুর মা আর রিতাকে। খবর পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে এসেছে রিতার মা। নাক আর কানে তুলা গোজা অবস্থায় মেয়েকে খাটিয়াতে শোয়ানো দেখে কাঁদছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে। কান্না বড় সংক্রামক ব্যাধি।
রিতার মায়ের এ কান্না সংক্রমিত হয়েছে সকল বস্তিবাসীর চোখে। মানব মন বড়ই অদ্ভুত!! মাত্র একদিন আগেও যে মেয়েটাকে বস্তির একটা মানুষ ও দেখতে পারত না, আড়ালে যাকে নিয়ে কানাঘুষা করতো সবাই, সবার কাছে যে ছিল খারাপ একটা মেয়ে কেবল এক দিনের ব্যাবধানে সেই মেয়েটার জন্যই চোখের জল ফেলছে সবাই। বস্তির সবার চোখে পানি, কাঁদছে না কেবল রোদ্দুর। অপলক কেবল তাকিয়ে আছে রিতার লাশটার দিকে। বিকেলের মধ্যেই মাটি হয়ে গেল রিতা আর বিশুর মায়ের।
বস্তির অদুরেই সরকারি গোরস্থানটাতে কবর দেয়া হলো ওদের। কবর দেয়া শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিতেই সৃষ্টি খেতে দেয় রোদ্দুরকে।
খেয়ে নে বাবা সারাদিন কিচ্ছু মুখে দিসনি। কোনো কথা না বলে চুপচাপ সামান্য খেয়ে নেয় ও। সারারাত বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে থাকে রিতার কথা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলো জানে না ও। আজ অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় ওর।
মনে হয় বুঝি পুরোটাই দুঃস্বপ্ন ছিল ওর। কিন্তু ওদের আধপোড়া ঘর দেখে ভুল ভাঙে। বাইরে এসে দেখে মা রান্না করছে। বাবা তখনও ঘুম। ওকে দেখে সৃষ্টি বলে কিরে এতো সকালে উঠলি যে আজ?
– ঘুম ভেঙে গেল মা।
– জানিস একটা না অবাক কান্ড ঘটে গেছে।।
– কি হয়েছে আবার?
– কারা যেন রাতের বেলায় চুপিচুপি এসে রিতাদের ঘরে এক লাখ টাকা রেখে গেছে।
কোনো কথা বলেনা রোদ্দুর। চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে যায়। ছেলের আকস্মিক পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সৃষ্টি । পড়াশোনা শেষ করে রেডি হয়ে ব্যাগ কাধে বেরোয় রোদ্দুর। না আজ আর ও স্কুলে যাওয়ার ভান করছে না, সত্যি সত্যি স্কুলে যাবে ও
ব্যাগ কাধে ওদের আড্ডার জায়গাটা পার হওয়ার সময়েই দেখে ওদের আড্ডার জায়গাটায় কেমন অপরাধী মুখে বসে আছে নুরা আর শামসু। রোদ্দুর না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলে দৌড়ে এগিয়ে আসে ওরা। ওদ্দুর দাড়া। শোন দোস্ত বলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
– সামনে থাইকা সর। ইস্কুলে যাইতাছি আমি।
– বিশ্বাস কর দোস্ত আমরা ইচ্ছা কইরা করি নাই, একজন আমাগো কইছিলো পেট্রোল ঢাইলা ওই ভাঙা ঘরটায় আগুন দিলে এক লাখ ট্যাকা দিব। আমরা বুজি নাই যে এমনডা হইবো বিশ্বাস কর!!
– অহন রাস্তা ছাড়। ভয় নাই তগো যা আমি কাউরে কই নাই তগো কথা। কমুও না যাহ।
রোদ্দুর এর হাত চেপে ধরে নুরা আর শামসু। তুই সবাইরে কইয়া দে ওদ্দুর, পুলিশ দিয়া আমাগো ধরায়া দে, তাও তুই রাগ কইরা থাকিস না আমাগো লগে। আমরা না তর বন্ধু!!
– হ আমিও এইডাই জানতাম এতোদিন যে তরা আমার বন্ধু। দেরি হয়া যাইতেছে আমার, সর অহন।
– ওদ্দুর ওই একটা ট্যাকাও আমরা খরচ করি নাই, পুরা এক লাখ ট্যাকাই রাইতের বেলা থুইয়া আইছি রিতাগো বাড়িত।
অদ্ভুত ভাবে তাকায় রোদ্দুর। তা তগো এক লাক ট্যাকা পাইয়া কি রিতা ফিরা আইছে???
রোদ্দুর এর চোখের দিকে তাকাতে পারে না ওরা। দুজনেই চোখ নামিয়ে নেয়।
– নাটক অনেক করছোস অহন রাস্তা ছাড়। নুরা আর শামসুর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। ওদ্দুর বলে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে নুরা। শামসুও ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলে থাক নুরা, যাইতে দে ওরে। ওরা শালা ভদ্দরনোক। আমাগো মতোন ছোটনোকগো সাথে ওয় আর ঘুরবো না।
শামসুর কথায় একবার থমকে দাঁড়ায় রোদ্দুর। পরক্ষণেই মনে পরে রিতাকে দেয়া কথা। না ও আর এদের সাথে ঘুরবে না, স্কুলে যাবে রোজ, ঠিকঠাক পড়াশোনা করবে। যেভাবেই হোক রিতাকে দেয়া কথা ওকে রাখতেই হবে। দ্রুত পা চালিয়ে স্কুলের দিকে চলে যায় ও। bangla golpo 2021
রিতা মারা যাবার পর থেকেই রোদ্দুর নিয়মিত স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে। সন্ধ্যার পরে আর বাইরে যায়না। আগের সেই ছটফটানি ভাবটাও আর নেই। বরং বয়সের তুলনায় বেশ গম্ভীর। পরিবর্তনটা চোখে পরে সৃজন সৃষ্টির ও। ওরা ভাবে যাক এতোদিনে তবু সুমতি হয়েছে ছেলেটার!!
কিন্তু ওরা কেউ জানলো না যে রিতা নামের মেয়েটা ওর জীবনের বিনিময়ে আজীবন এর মতোন বদলে দিয়ে গেল রোদ্দুরকে।।। (চলবে….)