ঠিক যেন লাভস্টোরী টু – 7
রিতার মৃত্যুর পরে পার হয়ে গেছে প্রায় চার বছর। এই চার বছরে পরিবর্তন বলতে রোদ্দুর লম্বায় বেড়েছে আরো ফুটখানেক। বুকটা চওড়া হয়েছে আরো৷ হাতের পেশিগুলো টি-শার্ট এর ওপর দিয়েই ফুটে থাকে। আগের সেই ছটফটানি ভাবটা পুরোটাই উধাও তার বদলে চোখে মুখে অদ্ভুত পোড় খাওয়া এক ধরনের কাঠিন্যের ছায়া, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝিলিক তাতে। এই চার বছরে রিতাকে দেয়া শেষ কথা গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে রোদ্দুর।
যে রোদ্দুর ক্লাস এইট এর বাধা দুই বারে কোনো রকমে ডিঙিয়েছিলো, সেই রোদ্দুর সবাইকে অবাক করে দিয়ে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পাশ করেছে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ নিয়ে। এখন পড়াশোনা করছে ভার্সিটির এডমিশন এর জন্য। সৃষ্টি যদিও চেয়েছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবে, কিন্তু বাবার মতোই সাহিত্যে ঝোক ছেলের। ওর একটাই কথা অনার্স করবে এবং সেটা বাংলা সাহিত্যে। বাবা মা আর বাধা দেয়নি ওর ইচ্ছাকে।
এদিকে বাবার মতোই গান পাগল হয়েছে ছেলেটা। ঢাকার কোথাও জেমস এর কনসার্ট আছে শুনলে যাবেই যাবে রোদ্দুর। আজো তার ব্যাতিক্রম হচ্ছে না। সামনেও এডমিশন টেস্ট! তা রেখে ছুটছে কনসার্ট দেখতে। একেতো জেমস এর কনসার্ট, তার ওপরে আবার সন্ধ্যাবেলা গিয়েই দেখে লোকে লোকারণ্য। কোনো রকমে যায়গা করে নেয় ভিড় ঠেলে। স্টেজে গিটার হাতে তখন জেমস। জেমস গান ধরেছে
“আমি আর আমার দু চোখ,
কখনো জলে ভেজাবো না
এ ব্যাথা আমারই থাক,
চাইনা কারো সান্তনা…..
তন্ময় হয়ে যায় রোদ্দুর গানে। মনে হতে থাকে ওকে নিয়েই বোধয় লিখা গানটা।
এই গান শেষ হতে শুরু হয়-
” এতো কষ্ট কষ্ট লাগে কেন অন্তরে,
যেন কান্নার কবিতা
তবু হাসতে হাসতে কাঁদি আমি ভুল করে,
আঁকি ব্যাথার ছবিটা,
পাবো হায় সুখের দেখা কি
নিঃসঙ্গ এই আমি একাকী
কেউ জানে কি, কেউ জানে কি
কতোটা আমি, আজ একাকী…
স্টেজে তাকিয়ে এখন আর জেমসকে দেখছে না রোদ্দুর, দেখছে একটা হাসিমুখ। গত চার বছরে এক মুহূর্তের জন্যও রোদ্দুর ভুলতে পারেনি মুখটা। হঠাৎ একটা রিনরিনে কন্ঠে হচ্ছে টা কি??? শুনে যেন বাস্তবে ফিরে আসে রোদ্দুর। তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে। ঠিক কাকে বললো বুঝতে পারলো না ও। ভালো করে তাকাতেই দেখলো পাশে দাড়ানো ছেলেটা ভিড় এর সুযোগে গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করছে মেয়েটার। হটাৎ করেই মাথায় রাগ চড়ে গেল রোদ্দুরের। হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরলো ছেলেটার কলার।
ভিড় থেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো ছেলেটাকে দূরে। ভিড় থেকে বাইরে এনে কষে এক চড় মারে গালে। কিবে শালা মাইয়া দেকলে লালা পরে? চল ফোট!!!
– আমার গায়ে হাত তোলা..
কথা শেষ করার আগেই আরেক থাপ্পড় দেয় রোদ্দুর।
– কি করবি বে? তোর কোন বাপরে ডাকবি ডাক। তেড়িবেড়ি করলে শালা এমন কেলান কেলাইমু না বে নিজের পায়ে দাড়াইবার পারবি না।
পায়ের আওয়াজ এ তাকিয়ে দেখে মেতেটিও ততক্ষনে সেখানে এসে গেছে। রোদ্দুর এর কথার টোন শুনেই কেমন চুপসে যায় ছেলেটা। চুপচাপ চলে যায়। মেয়েটি এগিয়ে আসে।
– ধন্যবাদ। আসলেই অনেকক্ষন ধরে অসভ্যতামো করছিলো।
– আরে না ম্যাডাম, ধন্যবাদ দেবার কি হলো!! মেয়েরা মায়ের জাত। আমি মেয়েদের অসম্মান দেখতে পারিনা।
কিছুক্ষণ আগেই রোদ্দুর যে টোনে কথা বলছিলো এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই দেখে অবাক হয় মেয়েটি।
– বাহহ আমিতো ভেবেছিলাম আপনি ওইভাবেই কথা বলে।
– হাঃ হাঃ আসলে ম্যাডাম যে দেবতার যেই ফুলে তুষ্টি। ওর সাথে ভদ্রতা দেখাতে গেলে উল্টো আরো পেয়ে বসত।
– সত্যি বলতে যখন ছেলেটাকে মারছিলেন তখন কিন্তু এতো ভদ্র মনে হয়নি আপনাকে!!
মেয়েটির কথায় মজা পায় রোদ্দুর।
– হাঃ হাঃ ভদ্র কই দেখলেন ম্যাডাম?? বস্তির ছেলে আমি, ওখানেই জন্ম। বস্তির বাইরে আসলে সবাই দেখে বলে ছোটলোক, আবার বস্তির ভেতরের লোকজন আমাকে বলে আমি নাকি ভদ্রলোক!! মাঝখানে কনফিউজড আমি নিজেই জানিনা যে আমি কি। হাঃ হাঃ
– দেখুন কে কোথায় থাকে সেটা ভদ্রলোক ছোটলোকের মাপকাঠি হতে পারে না, ভদ্রলোক ছোটোলোক বোঝা যায় তার আচরণে। বাই দ্যা ওয়ে আমি মেঘ বলে হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটা।
– আমি রোদ্দুর। বলে মেয়েটার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে মৃদু ঝাকুনী দিয়ে ছেড়ে দেয় রোদ্দুর।
– বাহহহ নামের মিল আছে দেখছি আমাদের।
– হাঃ হাঃ মিল কোথায় পেলেন ম্যাডাম? ওদের সম্পর্ক তো সাপে – নেউলে।
– মানে ঠিক বুঝলাম না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওই মেঘ আর রোদ্দুর এর কথা বলছি! সাপে নেউলে সম্পর্ক। মেঘ চায় রোদ্দুর কে ঢেকে দিতে, আর রোদ্দুর চায় মেঘের আড়াল থেকে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করতে।।
– হাঃ হাঃ বেশ মজার কথা বলেন তো আপনি!!
মেয়েটি হাসতে মুখের দিকে তাকায় রোদ্দুর। আহামরি সুন্দরী বলা যাবে না, তবে মেয়েটির হাসিটা চমৎকার। আপনি আমাকে একটা বিপদ থেকে বাঁচালেন। আমার হাতের এক কাপ চা পাওনা হয়েছে আমার। আমার বাসা এখান থেকে খুব দূরে না। গাড়িতে দশ মিনিট মতো লাগবে।
– না না৷ তার দরকার নেই!
– দরকার নেই কি বলছেন! আরে আসুন তো। বলে রোদ্দুর এর হাত ধরে টানে মেয়েটি।।
আসলে রিতার মৃত্যুর পর থেকেই মেয়েদের এড়িয়ে চলে রোদ্দুর। কিন্ত এই মেয়েটার মধ্যে এমন অদ্ভুত এক সারল্য আছে যে প্রথম দেখাতেই মুখের ওপরে না করতে পারলো না ও। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েটির সাথে এগিয়ে চলল রোদ্দুর। রোদ্দুরকে নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল মেয়েটি। রোদ্দুর মনে মনে বাবা নিজস্ব গাড়ি! তাহলে তো অনেক বড়লোক। দুরর রাজি হওয়াটাই আসলে উচিৎ হয়নি। এখন তো গাড়ি থেকে নেমেও যাওয়া যায়না।
– কি ভাবছেন?
– কিছুনা।
– আচ্ছা কিসে পড়ছেন আপনি???
– এইচএসসি পাশ করেছি এবারে, এডমিশন এর জন্য ট্রাই করছি।
– ওয়াও তাহলে তো আমরা সেইম ইয়ার। আমিও এডমিশন এর জন্য ট্রাই করছি। আমি ইউসিসিতে কোচিং করছি, আপনি কোথায়??
মুচকি হাসে রোদ্দুর। বস্তিতে থাকি, বাবা পঙ্গু একা মায়ের ইনকামে সংসার চলে! কোচিং আমার কাছে বিলাসিতা। বাড়িতেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
– ওহহ স্যরি।
– না, স্যরি বলার কি আছে এতে?
কথা বলতে বলতেই গাড়ি এসে থামে বিশাল গেট ওয়ালা একটা বাড়ির সামনে। দাড়োয়ান এসে গেট খুলে দিতেই ভেতরদ ঢুকে যায় গাড়িটা। অবাক চোখে চারপাশে তাকায় রোদ্দুর। আরি শালা এ দেখি বিশাল কারবার!! বাড়ির সামনে অনেক খানি জায়গা। সেখানে গালিচার মতো বেছানো সবুজ ঘাস তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে নুড়ি বেছানো পথ। একপাশে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, টেবিল ঘেরা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। একপাশে একটা ফোয়ারায় অনবরত পানি পরে চলেছে। সামনে সাদা ধবধবে রঙের দোতলা বাড়িটা।
এমন বাড়ি রোদ্দুর কেবল সিনেমা আর ক্যালেন্ডার এর পাতায় দেখেছে, বাস্তব দেখা এই প্রথম। চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকাতে থাকে বারবার। মেঘ ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ভেতরে। মেয়েটিকে দেখে আসলে বোঝা যায়না যে ওঁরা এত্তো বড়লোক!! মনে মনে নিজেকে গালাগাল দিতে থাকে রোদ্দুর। কি কুক্ষণে যে রাজি হয়েছিল আসতে!!
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে ড্রইং রুমটার লিকার পালিশ করা সেগুনের সোফায় বসে আছে এক ভদ্রলোক। এক হাতে আধপোড়া সিগারেট আরেক হাতে একটা গ্লাসে রঙ্গিন পানি! বুঝতে পারে রোদ্দুর গ্লাসের ওটা মদ!!
লোকটার মাথা কাঁচাপাকা মিশেল চুল, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সেটাও সাদা কালোর মিশেলে। চোখের ভারি ফ্রেমের চশমাটা চেহারাতে ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে। সামনের সেন্টার টেবিলটায় এক গাদা ফাইল পত্র খোলা। ঢুকেই কিছুটা যেন অবাক হয় মেঘ!! বলে তুমি এই সময়ে?? মুখ তুলে তাকিয়ে বলে হ্যা তাড়াতাড়িই ফিরলাম। উঠে দাঁড়ায় লোকটা। লম্বায় রোদ্দুর এর সমান, কিন্তু শরীর এর গঠন রোদ্দুর এর চেয়ে হালকা পাতলা।
ঠোঁটের কোনে ঝোলানো হাসিটায় একটা তাচ্ছিল্যের ভাব প্রচ্ছন্ন। রোদ্দুর এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘের বাবা, আর এম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির সত্ত্বাধিকারী মোঃ রবিউল হাসান!!!
মেঘকে জিজ্ঞেস করে সাথে কে??
রোদ্দুর এর কথা খুলে বলে মেঘ।
মেয়েকে বাঁচিয়েছে শুনে গভীরভাবে তাকায় রোদ্দুর এর দিকে।
– থ্যাঙ্কিউ ইয়াং ম্যান। আমার মেয়েকে তুমি বাঁচিয়েছ।
কিছুক্ষণ চোখ কুচকে থেকে বলে তোমার চোখদুটো আমার বড্ড পরিচিত!! কোথায় যেন দেখেছি!!!
– লোকে বলে আমি নাকি মায়ের চোখ পেয়েছি!! আর স্যার অবাক হওয়ার কি আছে? এই ছোট্ট শহরে আমাকেই হয়তো আগে দেখেছেন কোথাও! সে জন্য পরিচিত লাগছে!!
কেমন যেন উদাস হয়ে যায় রবিউল হাসান, কি বলছ ইয়াং ম্যান! ছোট্ট শহর! যতো ভাবছো ততোটা ছোটোও না, এই শহরের বুকেই গত প্রায় বিশ বছর যাবৎ দুটো মানুষকে খুঁজে চলেছি আমি! দেখা পাইনি একবারও। স্রেফ যেন হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে!!!
কথা বলতে বলতেই চেক বইটা টেনে বের করে খসখস করে সই করে পাতাটা ছিড়ে রোদ্দুর এর হাতে ধরিয়ে দেয় রবিউল। ইয়াং ম্যান আমি ঋণ রাখতে পছন্দ করিনা। আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছে তুমি। এখানে পপঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। ব্যাংক থেকে তুলে নিও।
রাগে গা জ্বলে ওঠে রোদ্দুর এর। পাশে তাকিয়ে দেখে ঠোঁটের কোনটা কামড়ে ধরেছে মেঘ।।
রোদ্দুর সোজা গিয়ে দাঁড়ায় মেঘের সামনে। এক হাতে মেঘের হাতটা ধরে অন্য হাতে চেকবই এর পাতাটা গুজে দেয় মেঘের হাতে।
– এই নিন ম্যাডাম এরপর থেকে এটাকে তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝোলাবেন!! আবার যদি কখনো বিপদে পরেন না চেচিয়ে বলবেন কে বাঁচাবে আমাকে? বাঁচালেই পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে!!! মেঘ কেবল নিচু হয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে থাকে। রোদ্দুর এর দেয়া চেকবই এর পাতাটা মুচড়ে ধরে হাতের মুঠোয়। রোদ্দুর আর কোনো কথা না বলে ঘুরে দাড়ায়।
দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে একবার এর জন্যেও পেছনে না তাকিয়ে। যদি তাকাতো তবে দেখতে পেত কি ঘৃনাভরা দৃষ্টিতে মেঘ তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে!!!!!
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিরবির করে রবিউল! এতো মিল কি করে হতে পারে? ঠিক যেন ওই দুটি চোখ!! চোখ দুটো আমি ভুলি কি করে!!!!!! valobasar golpo
এদিকে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে রাগে একদলা থুতু মাটিতে থুঃ করে ফেলে রোদ্দুর। আপনা আপনি ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শালা ভদ্দরনোক!!! (চলবে….)